প্রীতিলতা, আজও অমর //মর্জিনা খাতুন, নারী অধিকার কর্মী

প্রীতিলতা তোমার আত্মাহুতি দিবসে তোমাকে খুব মনে পড়ছে। সেই কিশোর বয়সে তোমার উপর লেখা পূর্নেন্দু দস্তিদারের ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ বইটি পড়েছিলাম। তখন থেকে তোমার সংগ্রাম আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। এরপর  তোমার উপর লেখা আরও অনেক বই পড়েছি। শংকর ঘোষ উনি তোমার উপর আরও একটি বই লিখেছেন যা অসাধারণ। তোমার দেখানো পথে মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে আমিও একজন। তোমার মাস্টার দা’র ‘বিজয়া’ লেখাটি তুমি যদি পড়তে পারতে তাহলে হয়তো অবাক হতে। তোমার দৃঢ়তা তাকে যে কিভাবে নাড়া দিয়েছে তা বলা বাহুল্য। স্বদেশকে মুক্ত করার জন্য তোমার দৃঢ়তা, সাহস, ব্যক্তিত্ব, তোমার সংগ্রাম আজও হাজার হাজার মেয়েদের মুক্তি সংগ্রামে পথ প্রদর্শন করে। তুমি আমাদের সাহসের উৎস, ব্যক্তিত্বের ও দৃঢ়তার উৎস। আত্মাহুতির আগের দিন তুমি মাকে লিখেছিলে, ‘মাগো,তুমি অমন করে কেঁদোনা! আমি যে সত্যের জন্য -স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি তাতে আনন্দ পাও না?

কি করবে মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী যে বিদেশীর অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভারে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা!

তুমি কি সব নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না? 

তোমার মতো অসীম সাহসী অনেক বীর মায়ের বুক খালি করে আত্মহতি দিয়ে বৃটিশ শাসন থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করেছে। বৃটিশের পর পাকিস্তানের প্রায় ঔপ্যনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে শহীদ রুমি, আজাদসহ হাজারো মুক্তিপাগল নারী-পুরুষ প্রাণ দিয়ে আমাদের মাতৃভুমিকে স্বাধীন করেছে। কিন্তু আমাদের প্রিয় মাতৃভমি বিদেশী শাসন থেকে মুক্ত হলেও এখনও অনাহারে-অর্ধাহারে-বেকারত্বে দিনাতিপাত করছে কোটি কোটি মানুষ। এখনও মুক্তি পাগল মানুষ শোষণ মুক্তির  লড়াই করছে।

প্রীাত, তুমিই ছিলে প্রথম নারী বিপ্লবী, প্রথম নারী শহীদ। বিপ্লবী দলে নারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিলো। তুমিই প্রথম তোমার দাদাকে প্রশ্ন করলে, “দাদা, আমরা  তোমাদের ওসব কাজ পারি না?”

তোমার দাদা উত্তর দিয়েছিল-“ না, মেয়েদের ওসব কাজ চলে না। গুলি চালাতে হবে, মারামারি করতে হবে-কত কঠিন সব কাজ, তোমাদের মত নরম মেয়েদের দিয়ে সে সব কাজ কি করে হবে?”

তুমি সাহসের সাথে উত্তর দিয়েছিলে, “ইতিহাসে দেখেছি ঝাঁসীর রাণী ঘোড়ায় চড়ে হাতে তলোয়ার নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছে। আমার নামও রাণী, আমিও পারব রাণী লক্ষীবাঈয়ের মত লড়তে। আমাকে তুমি সব শেখাও না – আমি চুরি করে তোমার বইয়ের ভিতর থেকে ‘বাঘা যতীন’,‘কানাইলাল’, ‘দেশের কথা’ বইগুলো পড়েছি। নাও না আমাকে তোমাদের দলে-স্বাধীনতার জন্য আমিও তাদের মত মরতে পারব।” সেদিন তোমার এই দৃঢ়তা বিপ্লবী দলে মেয়েদের অংশগ্রহণে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

“—স্বাধীনতার জন্য আমিও তাদের মত মরতে পারব”- চট্টগ্রামে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে তোমার আত্মাহুতির মাধ্যমে একথা প্রমাণ করেছে।  তুমি বলেছিলে, “আমি আশ্চর্য হয়ে যাই এই ভেবে যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী-পুরুষে ভেদাভেদ থাকবে কেন? —– আমরা আজকের যুগের মেয়েরা বিদেশী শাসন থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত করার মহৎ কাজ থেকে বঞ্চিত হব কেন? সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যদি ভাইয়েরা-বোনেরা পাশাপাশি লড়াই করতে পারে তবে বিপ্লবী আন্দোলনেই বা পারবে না কেন? এর কারণ কি এই যে, দু’টো আন্দোলনের ধারা আলাদা, না মেয়েরা বিপ্লবী আন্দোলনের উপযুক্ত নয়? —– সামর্থের কথা যদি ধরা হয় তবে স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরুষের চেয়ে নারীরা কম সক্ষম একথা মনে করা কি অন্যায় নয়? এই ভুল ধারণা দূর করবার সময় আজ এসেছে।

মেয়েরা যে এখনও পিছিয়ে আছে তার কারণ তাদের পিছনে ফেলে রাখা হয়েছে। নারীরা এখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে তারা আর পিছিয়ে থাকবে না এবং সংগ্রাম যতই কঠিন ও বিপদ সঙ্কুল হোক না কেন ভাইয়েদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তারাও সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি আমার বোনেরা আর নিজেদের দুর্বল ভাববেন না, এবং ভারতের বিপ্লবী সংগ্রামে হাজারে হাজারে যোগদান করে সমস্ত বাধা এবং বিঘেœর সম্মুখীন হবেন।”

আদর্শের প্রতি তোমার এই নিষ্ঠা, দেশের প্রতি তোমার ভালোবাসা ও তোমার আত্মত্যাগ আমাদের সামনে অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত। তুমি বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে, হাজারো মুক্তি সংগ্রামী মানুষের মাঝে। ৮৮ তম আত্মহুতি দিবসে তোমার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা। 

(জন্ম ৫ মে ১৯১১-আত্মাহুতি ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩২। )

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *