ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনঃ আকাঙ্খা ও বাস্তবতা // মর্জিনা খাতুন

১৯৯৫ সালে দিনাজপুরের দশমাইলে পুলিশ কৃর্তৃক ইয়াসমিনকে গণধর্ষণ ও হত্যার পর দিনাজপুরসহ সারাদেশবাসী প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। সেদিন দাবি ছিল ধর্ষক ও তার সহযোগীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। পরবর্তীতে ধর্ষণের সাথে জড়িত তিন পুলিশ সদস্যের ফাঁসি কার্যকর হলেও যারা ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেছিল তাদের অপরাধের কোনো বিচার হয়নি। ফলে অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকরা সবসময় অন্তরালে থেকে  গেছে এবং যাচ্ছে। তারা বিচারের আওতায় আসছে না। ২০২০ সালে সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনা এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, যারা ধর্ষক তারা শুধু একটি অপরাধের সাথে জড়িত নয়। বিগত দিনেও তারা অপরাধ করেছে এবং ছাড়া পেয়েছে। অপরাধী অপরাধ সংঘটিত করছে অথচ ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। ন্যায়বিচার না পাওয়ার যে সংস্কৃতি, তার বিরুদ্ধে ছিল আন্দোলনকারী সহ দেশবাসীর ক্ষোভ ও বেদনা। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রকাশিত তথ্য মতে, গড়ে প্রতিদিন ৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। আর বিচার হচ্চে, মাত্র ১ শতাংশের কম।  ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ কালের কন্ঠে প্রকাশিত সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে ধর্ষণের ঘটনায় ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস  সেন্টার  থেকে মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৫৪১টি। এর মধ্যে আসামির শাস্তি হয়েছে মাত্র ৬০টি ঘটনায়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্য সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। বছরের পর বছর মামলা ঝুলছে।

সাম্প্রতিক কালে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, ধর্ষক ও নির্যাতকরা ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী। ধর্ষকরা সবসময় আশ্রয়-প্রশয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় থাকে। ফলে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার নারী বা শিশুর ন্যায় বিচার প্রাপ্তি  দুঃসাধ্য। ধর্ষণের আলামত সংরক্ষণ ও ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষা আরও দুরূহ ব্যাপার। পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার নারী  আরও একবার ধর্ষণের মুখোমুখি হয়, যার প্রমাণ মিলেছে নুশরাত হত্যার ঘটনায়। নুশরাত বেঁচে থাকতে প্রশাসন কোনোভাবেই সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। একইভাবে সাভারে নীলা রায় হত্যার ঘটনাতে নীলার পরিবার পুলিশ প্রশাসনের কোনো সহযোগিতা পায়নি। নীলা হত্যার পর প্রশাসন তৎপর হয়েছে। মাত্র কয়েকমাসে এই ঘটনাগুলি জনমনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে যার ফলশ্রæতিতে গড়ে উঠেছে “ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ” ফøাটফরম। ১০ অক্টোবর  তারা শাহবাগে  মহাসমাবেশ শেষে ৯ দফা দাবি উত্থাপন করেছে। দাবিসমুহ হলো –

১। সারাদেশে অব্যাহত ধর্ষণ-নাররি প্রতি সহিংসতার সাথে যুক্তদের দৃষ্টানতমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণ, নিপীড়ন বন্ধ ও বিচারে ব্যর্থ স্বরাষ্টমন্ত্রীকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে। 

২। পাহাড়-সমতলে আদিবাসী নারীদের ওপর সামরিক -বেসামরিক সকল প্রকার যৌন সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে।

৩। হাইকোর্টের নিদের্শনানুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতন বিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে। সিডো সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল আইন ও প্রথা বিলোপ করতে হবে। 

৪। ধর্মীয় সহ সকল ধরনের সভা-সমাবেশে নারীবিরোধী বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সাহিত্য, নাটক, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন বন্ধ করতে হবে। পর্নোগ্রাফী নিয়ন্ত্রণে বিটিসিএল এর কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে। সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক চর্চায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতে হবে।

৫। তদন্তকালীন সময়ে ভিকটিমকে মানসিক নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ভিকটিমের আইনগত ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

৬। অপরাধ বিজ্ঞান ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে অনিষ্পন্ন সকল মামলা দ্রæত নিষ্পন্ন করতে হবে।

৭। ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে  সাক্ষ্য আইন ১৯৭২ এর  ১৫৫ (৪) ধারা বিলোপ করতে হবে ডিএনএ পরীক্ষাকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে

৮। পাঠ্যপুস্তকে নারীর প্রতি অবমাননা ও বৈষম্যমূলক যেকোন প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পরিচ্ছদ, ছবি, নির্দেশনা ও শব্দ চয়ন পরিহার করতে হবে

৯। গ্রামীণ সালিশের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য াপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।

২০১৮ সাল থেকে ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট (১৭টি  নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত) ধর্ষণ আইন সংস্কার এখনই সংক্রান্ত প্রচারনা শুরু করেছিল। প্রচানার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল ধর্ষণ রোধে ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ফাঁক ফোকর সনাক্ত করা এবং এই ফাঁকগুলি কাটিয়ে ওঠার জন্য সংস্কার সংক্রান্ত প্রস্তাবনাসমূহ প্রণয়ন করা। এই প্রচারণার অংশ হিসেবে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন সংশোধনের দাবির জন্য ধর্ষণ আইন সংশোধন জোট তৈরি হয়েছিল। দেশজুড়ে ধর্ষণ-বিরোধী বিক্ষোভের প্রতি সংহতি জানিয়ে ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট ধর্ষণের ন্যায়বিচারের জন্য ১০ (দশ) দফা দাবি জানিয়েছে। দাবিগুলো হলো – 

১। মানবাধিকার মানদন্ডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধর্ষণ আইনের সংস্কারঃ ধর্ষণের শিকার বা ব্যক্তিদের (লিঙ্গ, জেন্ডার, যৌনতা, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, জাতীয়তা, প্রতিবন্ধিতা ও বয়স নির্বিশেষে) সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে এবং নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সকলের অধিকার রক্ষা করতে বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের ( সিডো, সিআরসি এবং আইসিসিপিআর সহ অন্যান্য) সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধর্ষণ আইন সংস্কার করতে হবে।

২। ধর্ষণের সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করে তা বৈষম্যহীন করাঃ অপরাধী বা ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের জেন্ডার নির্বিশেষে সম্মতিহীন সব ধরনের পেনেট্রেশনকে আওতাভুক্ত করে ধর্ষণকে পুনসংজ্ঞায়িত করতে হবে।

৩। ধর্ষণের আইনে “ পেনিট্রেশন” কে অর্থাৎ যোনি, মলদ্বার বা ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির যৌনাঙ্গের মুখে বা অন্য কোন বস্তুর প্রতিস্থাপনকে ( পেনিট্রেশন) ধর্ষণের সংজ্ঞায় অন্তর্ভূক্ত করা।

৪। শাস্তির আনুপাতিকতা প্রদান করা এবং সাজা প্রদানের নির্দেশিকা প্রবর্তন করাঃ  সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে বিচারকদের সুবিবেচনা (discretion) প্রয়োগ করার জন্য আইন সংশোধন এবং প্রয়োজনীয় সাজা প্রদান নির্দেশিকা (Sentencing Guideline) প্রণয়ন করা যা শাস্তির আনুপাতিকতা নিশ্চিত করে এবং অন্যান্য যৌক্তিক বিষয়সমূহ ( যেমন, অভিযুক্ত ব্যক্তির বয়স ও মানসিক স্বাস্থ্য) এবং উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ( যেমন অস্ত্রের ব্যবহার, বলপ্রয়োগ বা সহিংসতা এবং ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির স্থায়ী শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি) বিবেচনা  করে।

৫। ধর্ষণের শিকার প্রতিবন্ধি ব্যক্তির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাঃ ধর্ষণের শিকার প্রতিবন্ধি ব্যক্তির ন্যায়বিচারের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। ভাষা, শ্রবণ ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি ব্যক্তিগণ যেন প্রতিবন্ধিতার কারণে ধর্ষণের বিচারের ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতার শিকার না হন তার জন্য ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের সংস্কার করতে হবে।

৬। ধর্ষণ মামলায় অভিযোগকারী ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির চরিত্রগত সাক্ষ্যের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করাঃ সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য ধারা সংশোধনের মাধ্যমে ধর্ষণ মামলার বিচারে অভিযোগকারীর চরিত্রগত সাক্ষ্য বিবেচনায় আনা বন্ধ করতে হবে। এরূপ সংস্কারের মাধ্যমে বিচারকগণ যাতে নিশ্চিত করতে পারেন যে আসামী পক্ষের আইনজীবীগণ  জেরার সময় অভিযোগকারীকে কোন অবমাননাকর বা অবজ্ঞামূলক প্রশ্ন না করে।

৭। সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নঃ খসড়া ভিকটিম ও সাক্ষী সুরক্ষা বিল ( ২০০৬ সালে আইন কমিশন প্রথম খসড়া তৈরি করেছিল এবং ২০১১ সালে এটি পর্যালোচনা করা হয়েছে) পুর্নবিবেচনা করে এই বিলটি পাস করা যাতে করে ভিকটিম  সাক্ষীগণ প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা, জরুরী আশ্রয়, জীবিকা নির্বাহের সহায়তা, মনো-সামাজিক সহায়তা এবং প্রয়োজন অনুসারে তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা যেন হুমকির মুখে না পড়ে তাদের নিরাপত্তার সন্তোষজনক বিকল্প ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত এ জাতীয় সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের জন্য রাষ্ট্র পরিচালিত একটি ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন করাঃ রাষ্ট্র পরিচালিত একটি “ক্ষতিপূরণ তহবিল” গঠন করা, যেন ধর্ষণ প্রমাণ হওয়া সাপেক্ষে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। এক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ক্ষেত্রে অপরাধী চিহ্নিত হয়েছে কিনা বা তার বিচার হয়েছে কিনা তা বিবেচিত হবে না।

প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারঃ

৯। বিচার ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জেন্ডার সংবেদনশীলতা বিষয়ক প্রশিক্ষণঃ পুলিশ, আইনজীবী (প্রসিকিউশন/ডিফেন্স), বিচারক এবং সমাজ কর্মীদের জন্য জেন্ডার সংবেদনশীলতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ আয়োজন করা, যেন বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়ায় ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির সঙ্গে সংবেদনশীল আচরণ করা হয় ।

১০। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠক্রমে সম্মতি সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা ঃ জেন্ডার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে ধারণা এবং প্রচলিত নেতিবাচক সামাজিক রীতি-নীতি পরিবর্তন করার জন্য সম্মতি ও পছন্দের ধারণাসমুহ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ( বিশেষতঃ ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার অন্যান্য ধরণ) সম্পর্কিত তথ্য প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকে পাঠক্রমে অন্তর্ভূক্ত করা।

এখন আমাদের জানা দরকার, বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)  এ ধর্ষণ সংক্রান্ত কি কি বিধান আছে?

আমরা জানি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি নারী অধিকার কর্মীদের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে সরকার কর্তৃক প্রণীত আইন হিসেবে আমরা পেয়েছি। নারী ধর্ষণ সংক্রান্ত বিধান  দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় সন্নিবেশিত আছে। এছাড়া যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০, নারী নির্যাতন (নিবর্তক শাস্তি) অধ্যাদেশ ১৯৮৩, নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন ১৯৯৫ ইত্যাদি ধারাবাহিক ভাবে প্রণীত হয়েছে। সময়ের পরিবর্তনে ও প্রয়োজনে ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন আইন পরিবর্তন করে ২০০০ সালে প্রণীত হয় “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০। পরবর্তীতে ২০০৩ এ আইনটির কিছু ধারা সংশোধন করা হয়। সংশোধনীসহ এই আইনে মোট ৩৪ টি ধারা আছে যার মধ্যে ১ থেকে ১৪ ধারা পর্যন্ত অপরাধের সংজ্ঞা, ধরণ ও শাস্তি বিষয়ে এবং ১৫ থেকে ৩৪ পর্যন্ত বিচার পদ্ধতির বিষয় সমূহ আলোচনা করা হয়েছে।

এই আইনের  ৯ ধারায় ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু ইত্যাদির শাস্তির বিধান আছে। এর ৫টি উপধারা আছে।  এই আইনের ৯(১) ধারায়  “নারী ধর্ষণ” এর শাস্তি স্বরূপ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ৯ (১) ধারার ব্যাখ্যায় ‘ধর্ষণ’ সম্পর্কে বলা হয়েছে – “বিবাহ ব্যতীত ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার অসম্মতিতে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায় করে অথবা ১৬ বছরের বয়সের  কম কোন নারীর সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সর্ম্পক স্থাপন  করলে তা নারী ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে।”

৯(২) থেকে ৯(৫) পর্যন্ত উপধারায় ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যুর শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে। 

৯(২) উপধারায় বলা হয়েছে, “ধর্ষণের দরুণ তাৎক্ষণিক বা তারপর ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে অপরাধীর মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড সহ ১লাখ টাকা অর্থদন্ড হবে।” 

৯(৩) উপধারায় দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তীতে মৃত্যু ঘটলে সর্বোচ্চ শাস্তি কি হবে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, “একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধ হয়ে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে এবং তার ফলে ধর্ষণের শিকার নারীর মৃত্যু হলে বা আহত হলে ঐ দলের প্রত্যেকেরই মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা অর্থদন্ড হবে।”

৯(৪) উপধারায় ধর্ষণপূর্বক মৃত্যু বা আহত করার শাস্তির বিধান আছে। এই ধারা অনুযায়ী কোন নারী বা শিশুকে –

(ক) ধর্ষণপূর্বক মৃত্যু বা আহত করার চেষ্টা করলে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড এবং আর্থিক দন্ড করা হবে।

(খ) ধর্ষণের চেষ্টা করা হলে অনধিক ১০ বছর কিন্তু সর্বনিম্ন ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং আর্থিক দন্ড হবে। 

৯(৫) উপধারা  অনুযায়ী পুলিশের হেফাজতে থাকাকালে কোন নারী ধর্ষণের শিকার হলে, উক্ত নারী পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় ধর্ষণের হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছে উক্ত নারী যেসব পুলিশের হেফাজতে ছিল, সে বা তারা প্রত্যেকে বা, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হলে, অনধিক ১০ বছর কিন্তু সর্বনিম্ন ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং  অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা আর্থিক দন্ড হবে।

এই আইনের ১৩(১) ধারায় ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে জন্মলাভকারী শিশু সংক্রান্ত বিধান সম্পর্কে  বলা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, “অন্য  কোন আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না  কেন, ধর্ষণের কারণে কোন সন্তান জন্মলাভ করলে-

(ক) উক্ত সন্তানকে তার মাতা কিংবা তার মাতৃকুলীয় আত্মীয় স্বজনের তত্ত¡াবধানে রাখা যাবে;

(খ) উক্ত সন্তান তার পিতা বা মাতা, কিংবা উভয়ের পরিচয়ে পরিচিত হবার অধিকারী হবে;

(গ) উক্ত সন্তানের ভরণপোষণের ব্যয় রাষ্ট্র বহন করবে;

(ঘ) উক্ত সন্তানের ভরণপোষণের ব্যয় তার বয়স একুশ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত  প্রদান করতে হবে। তবে একুশ বছরের অধিক বয়স্ক কন্যা সন্তানের  ক্ষেত্রে তার বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত এবং পঙ্গু সন্তানের ক্ষেত্রে নিজে ভরণপোষণের  যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত তার ব্যয় বহন করতে হবে।

(২) সরকার বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে উপধারা (১) এ উল্লিখিত সন্তানের ভরণপোষণ বাবদ প্রদেয় অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করবে৷

(৩) এই ধারার অধীন  কোন সন্তানকে ভরণপোষণের জন্য প্রদানকৃত অর্থ সরকার ধর্ষকের নিকট হতে আদায় করতে পারবে এবং ধর্ষকের বিদ্যমান সম্পদ হইতে উক্ত অর্থ আদায় করা সম্ভব না হলে, ভবিষ্যতে তিনি  যে সম্পদের মালিক বা অধিকারী হবেন সেই সম্পদ হতে তা আদায় করা হবে। ”

এই আইনের ৩২ ধারায় অপরাধের শিকার ব্যক্তির মেডিকেল পরীক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে। ভিকটিম সরকারি ও সরকার অনুমোদিত যে কোন বেসরকারি হাসপাতালে মেডিক্যাল পরীক্ষা করতে পারবেন। পরীক্ষার পর প্রতিবেদনের একটি কপি আবেদনকারী কর্তৃপক্ষকে সরবরাহ করবে। কোন ডাক্তার পরীক্ষা করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের বিধানও রয়েছে।

এই আইনের বিচার প্রক্রিয়ার বিষয়সমুহ ১৫-৩৪ ধারায়  সংরক্ষিত করা হয়েছে। ‘নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল’ নামক আদালতে  নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত সব অপাধের বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার বিধান আছে। 

১৩ অক্টোবর ২০২০ ঘোষিত সরকারি অধ্যাদেশ নং ৪, ২০২০

 এ অধ্যাদেশে “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ ( ২০০০ সালের ৮ নং আইন) এ কি কি সংশোধন হয়েছে তা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। সংশোধনীসমুহ নিম্নরূপঃ

সংশোধনী ১ এ সংক্ষিপ্ত শিরোনাম ও প্রবর্তন সম্পর্কে বলা হয়েছে। ১) এই অধ্যাদেশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন অধ্যাদেশ, ২০২০ নামে অভিহিত হবে। এবং ২) ইহা অবিলম্বে কার্যতকর হবে।

সংশোধনী ২ এ ধারা ৭ এর “ধারা ৫ এ উল্লিখিত” শব্দ, সংখ্যা এবং চিহ্নের পরিবর্তে “ মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর ধারা ৩ ও ৬ এ উল্লিখিত শব্দগুলি, কমা, সংখ্যাগুলি এবং বন্ধনী প্রতিস্থাপিত হবে।

সংশোধনী ৩ এ বলা হয়েছে, উক্ত আইনের ৯ এর –

ক) উপ-ধারা (১) এর “যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে” শব্দগুলির পরিবর্তে “ মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে” শব্দগুলি প্রতিস্থাপিত হবে।

খ) উপ-ধারা ৪ এর দফা (ক) এর “যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে” শব্দগুলির পরিবর্তে “মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে” শব্দগুলি প্রতিস্থাপিত হবে।

গ) উপ-ধারা (৫) এর “দায়ী” শব্দের পরিবর্তে “দায়িত্বপ্রাপ্ত” শব্দ প্রতিস্থাপিত হবে।

সংশোধনী ৪ এ ধারা ১৯ এর সংশোধন সম্পর্কে বলা হয়েছে। ধারা ১৯ এর উপ-ধারা (১) এর পরিবর্তে নিম্নরূপ উপ-ধারা (১) প্রতিস্থাপিত হবে। যথা:-

এই আইনের অধীন সকল অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণীয় হবে এবং ধারা ১১ এর দফা গ এ উল্লেখিত অপরাধ আপসযোগ্য হবে।

সংশোধনী ৫ এ বলা হয়েছে, উক্ত আইনের ধারা ২০ এর –

ক) উপ-ধারা (১) এর “ধারা ২৫ এর” শব্দগুলি এবং সংখ্যার পরিবর্তে “ধারা ২৬ এর” শব্দগুলি এবং সংখ্যা প্রতিস্থাপিত হবে। এবং

খ) উপ-ধারা (৭) এর “চিলড্রেন অ্যাক্ট ১৯৭৪” শব্দগুলি, কমা, সংখ্যাগুলি এবং বন্ধনীর পরিবর্তে শিশু আইন ২০১৩ শব্দগুলি, কমা, সংখ্যাগুলি এবং বন্ধনী প্রতিস্থাপিত হবে।

সংশোধনী ৬ ধারা ৩২ এর সংশোধনী সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই আইনের ধারা ৩২ এর –

ক) উপায়ন্তটিকার “ অপরাধের শিকার ব্যক্তির মেডিকেল পরীক্ষা” শব্দগুলির পরিবর্তে “অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির মেডিকেল পরীক্ষা” শব্দগুলি প্রতিস্থাপিত হবে। এবং

খ) উপ-ধারা (১) এর “ অপরাধের শিকার ব্যক্তির” শব্দগুলির পরিবর্তে “ অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করিয়া” শব্দগুলি প্রতিস্থাপিত হবে।

সংশোধনী ৭ এ ৩২ক সন্নিবেশ করা হয়েছে।

৩২ক। অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষা। এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ধারা ৩২ এর অধীন মেডিক্যাল পরীক্ষা ছাড়াও, উক্ত ব্যক্তির সম্মতি থাকুক বা না থাকুক, ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) আইন ২০১৪ এর বিধান অনুযায়ী ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষা করতে হবে।

উল্লেখিত দাবিগুলির সাথে সংশোধনীর বিষয়সমূহের তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, “ধর্ষণ” এর সুস্পষ্ট সংজ্ঞা, পেনিট্রেশন, প্রতিবন্ধি ব্যক্তির বিচার, ক্ষতিপূরণ, সাক্ষীর সুরক্ষা, শাস্তির আনুপাতিকতা প্রদান ও নির্দেশিকা প্রদান, নারী বান্ধব বিচার ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সাক্ষ্য আইনে ১৫৫(৪) ধারা বাতিলের যে দাবি, তা বাস্তবায়নের জন্য নারী অধিকার কর্মীদের আন্দোলন অব্যাহত থাকাই যৌক্তিক। ২০১০ সালে হাইকোর্ট যৌনহয়রানী বন্ধে যে নির্দেশনা দিয়েছিল সেই নির্দেশনার বাস্তবায়ন তেমন একটা নেই। পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইনও বৈষম্যমূলক। ফলে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক এবং দন্ডের মাত্রা বৃদ্ধি করে নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তি কতটা সম্ভব তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। সর্বত্র নারীর নিরাপদ জীবন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ছাড়া নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন বন্ধ করা দুরূহ। তাই ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্রে-পরিবহনসহ সর্বত্র নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ রাষ্টকে নিতে হবে। ছাত্র-যুব-নারীসমাজ পথে নেমেছে, তারা দাবি তুলেছে, নারীকে রক্ষা করা নয়, নারীকে মুক্তি দিতে হবে। এই মুক্তির লড়াইয়ে আমরা সামিল হব, আমাদের মুক্তির লড়াই বেগবান করবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *