‘মৃত্যুর পরেও আমি চাই বেঁচে থাকতে’- আনা ফ্রাঙ্ক

জন্ম ১২ জুন ১৯২৯-মৃত্যু ১৯৪৫

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানীতে হিটলারের জাতি-বিদ্বেষ নীতির কারণে হাজার হাজার ইহুদিকে নিধন করা হয়েছিল তেমনি একবিংশ শতাব্দীতেও সাদা-কালো, ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু জাত-পাতের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষকে জীবন দিতে হচ্ছে। এখনো বিদ্বেষ নীতির অবসান হয়নি। শুধু গায়ের রং কালো হওয়ার কারণে জর্জ ফ্রয়েড পুলিশের হাটুঁর চাপে মাত্র ৮ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। জজ ফ্রয়েড হত্যার ন্যায়বিচারের দাবিতে গোটা আমেরিকাসহ ইউরোপের মানুষ লড়ছে আমেরিকার শাসকশ্রেণীর বিদ্বেষ নীতির বিরুদ্ধে। তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একদিকে নাৎসী বাহিনী অন্যদিকে গোটা বিশ্ব লড়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল গ্রাস থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য। এই বিশ্বযুদ্ধের সময় পৃথিবীকে রক্ষার জন্য যে দেশ সবচেয়ে বেশি নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছিল সে দেশ হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। সমাজতান্ত্রিক  সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন এই বিশ্বযুদ্ধে নেতৃত্বদান করে পৃথিবীকে নতুনভাবে বাসযোগ্য করেছে।

হিটলারের জাতি বিদ্ধেষ নীতির কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানীর যে পরিবারটির  কথা এখনো আমরা সবাই জানি সেই পরিবারটি হলো ফ্রাঙ্ক পরিবার।  জার্মানীতি তখন হিটলারের নেতৃত্বে সুপরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল উগ্র জাতীয়তাবাদ। তীব্র আক্রমণ শুরু হয়েছিল ইহুদির প্রতি। ফ্রাঙ্ক পরিবারও ছিল ধর্মবিচারে ইহুদি। এই ফ্রাঙ্ক পরিবারে জন্ম নিয়েছিল ফুটফুটে আনা, যার পূর্ণ নাম আনা ফ্রাঙ্ক। ‘মৃত্যুর পরেও আমি চাই বেঁচে থাকতে’ – সত্যি সত্যি সে আমাদের সবার মাঝে বেঁচে আছে ডায়েরী বা দিনলিপি লেখক আনা ফ্রাঙ্ক। যে ডায়েরীতে ফুটে ওঠেছিল আনা ফ্রাঙ্কের সংবেদনশীল মনের চিত্র, তার জীবনবোধ, মানুষ-প্রকৃতি-ঈশ্বর বিষয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, ভয়ংকর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাও।

আনার জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ জুন জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুট -অন-মাইন শহরে। বাবা অটো ফ্রাঙ্ক, মা এডিথ হল্যান্ডার। প্রথম সন্তান মারগট, দ্বিতীয় সন্তান আনা ফ্রাঙ্ক।

আনার বয়স যখন চার বছর তখন হিটলারের বিদ্বেষ নীতির কারণে জার্মানী ইহুদির জন্য  বাসযোগ্য থাকল না। তখন আতঙ্কিত ফ্রাঙ্ক পরিবার তাদের দুই সন্তানকে নিয়ে ১৯৩৩ সালে জার্মানী ছেড়ে হল্যান্ডে চলে যান। সেখানে আমস্টার্ডামে বাবা অটো ফ্রাঙ্ক  চাকুরি নিলেন ট্রাভিস এন.ভি-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদে। পাঁচ বছরের আনা ভর্তি হলেন মন্তেসরি কিন্ডারগার্টেনে। বড় বোন মারগট আর আনার জীবন বেড়ে ওঠছিল আমস্টার্ডাম শহরের আলো-বাতাস আর ছায়ায়।

১৯৩৯ সালে আনা ফ্রাঙ্ক পা দিল ১০ বছরে। শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তখনও স্বাভাবিক জীবন যাপনই ছিল আনাদের পরিবারের। ১৯৪১ সালে আনা ফ্রাঙ্ক ভর্তি হলো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এই সময় জার্মানীর রাজপথ স্নাত হচ্ছে ইহুদিদের রক্তে। হতভাগ্য অগণিত ইহুদিরা দিন কাটাচ্ছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, মৃত্যুপুরীতে। অনেকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে অনিশ্চিত পথে পা বাঁড়িয়েছিলেন। এবং এই নির্বাসিতদের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও ছিলেন।

১৯৪১ সালেই জার্মানীর নাৎসী বাহিনী হল্যান্ড দখল করল। একের পর এক ইহুদি বিরোধী নীতি রাজী করল দখলদার নাৎসী বাহিনী।  ‘ইহুদিরা বাসে চড়তে পারবে না,  ট্রেনে চড়তে পারবে না, ‘ইহুদির দোকান’ এরূপ সাইনবোর্ড টাঙ্গানো দোকান থেকে কেনাকাটা করতে হবে, বাইসাইকেল চালানো যাবে না, সিনেমা-থিয়েটারে কিংবা বারোয়ারি খেলা-ধূলায় ইহুদির প্রবেশ নিষেধ, রাত আটটার পরে বাহিরে যাওয়া নিষেধ। এছাড়াও ইহুদির স্কুল ছিল নিদিষ্ট এবং প্রত্যেক ইহুদির জামায় চিহ্নস্বরূপ ছ’কোনা ‘হলুদ তারা’ লাগানো বাধ্যতামূলক। এটি ছিল ইহুদির পরিচয়ঘোষক।

এভাবে অত্যাচারের নতুন নজীর প্রত্যক্ষ করল হল্যান্ডের ইহুদিরা।  ১৯৪২ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তিন বছরের দানব। সারা পৃথিবীকে তছনছ করছে। ঠিক সেই সময়ে নাৎসী বাহিনী ১৯৪২ সালের ৫ জুলাই অটো ফ্রাঙ্কের নামে সমন পাঠালো। কিন্তু অটো ফ্রাঙ্ক আত্মসমর্পন করে বন্দিশিবিরের বাসিন্দা হতে রাজি ছিলেন না। কয়েকজন বন্ধুর সাহায্য নিয়ে অফিস বাড়ির পিছনে বানিয়ে নিয়েছিলেন ‘গোপন আস্তানা’।  ৬ জুলাই থেকে ঐ গোপন বাড়ির বাসিন্দা হলো দু’টো ইহুদি পরিবার। দু’টি পরিবারের মোট আটজন সদস্য যার মধ্যে ছিল – ফ্রাঙ্ক পরিবারে চারজন এবং বন্ধু ফান ডান পরিবারের তিনজন আর ডাসেল। আত্মগোপনের সময় আনার বয়স ছিল ঠিক তের বছর চব্বিশ দিন। চব্বিশ দিন আগে আনার জন্মদিনে বাবা উপহার দিয়েছিলেন একটি ডায়েরী। এই সেই ডায়েরী যা এখনো ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে আমাদের পাঠ্য হয়ে আছে।

এই আস্তানার সীমিত গন্ডির মধ্যে কেটেছিল দুই বছর এক মাস অর্থাৎ পঁচিশ মাস। এই পঁচিশ মাসে ঐ ডায়েরীর পৃষ্ঠায় জন্ম নিয়েছিল নতুন এক আনা ফ্রাঙ্ক। ১৯৪৪ সালের ১ লা আগস্ট মঙ্গলবার পর্যন্ত আনা ফ্রাঙ্ক এই ডায়েরী লিখেছিল। তার ঠিক তিন দিন পর ৪ আগস্ট শুক্রবার, গোপন আস্তানায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হায়েনা- নাৎসী পুলিশ বাহিনীর কিলিং স্কোয়াডের সক্রিয় সদস্য। অর্থের বিনিময়ে কে বা কারা এই আস্তানার খরব দিয়েছিল নাৎসী বাহিনীকে। পঁচিশ মাসের আশ্রয়টি তছনছ করে আটজন মানুষকে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিল নাৎসী বাহিনী- যাদের একমাত্র অপরাধ ছিল যে তারা জন্মসুত্রে ইহুদি। নাৎসীবাহিনী চলে যাওয়ার পরে ঐ মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ঐ ডায়েরী, খাতাপত্র আর কাগুজের বান্ডিল। ফ্রাঙ্ক পরিবারের দু’জন শুভার্থী পরের সপ্তাহে এসব উদ্ধার করেন।  মেঝেতে পড়ে থাকা ঐ ডায়েরীই ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী’ নামে পরিচিত।

নাৎসী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পরে তাদেরকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আনা ফ্রাঙ্ক ও তার  বোন মারগট ফ্রাঙ্ক বার্গেন- বেলজান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেই  ১৯৪৫ সালে টাইফাসে আক্রান্ত হয়ে তারা দুজনেই মৃত্যুবরণ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে পরিবারের একমাত্র  বেঁচে থাকা ব্যক্তি বাবা অটো ফ্রাংক  ওডেসা আর মার্সেই হয়ে আমস্টাডামে ফিরে আসেন।  তখন তাঁর হাতে লেখাগুলো তুলে  দেন সেই শুভার্থীরা। পাতা উল্টেছিলেন বাবা অটো ফ্রাঙ্ক। তারপর ইতিহাস। বাবা অটো ফ্রাঙ্কের প্রচেষ্টাতেই ১৯৪৭ সালে ডায়েরীটি প্রথমে ওলন্দাজ ভাষাতে প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে প্রথমবারের মতো তা ইংরেজীতে অনুদিত হয়।  এই ডায়েরীতে  আনার জীবনের ১২ জুন ১৯৪২  থেকে ১ আগস্ট ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সময়ের ঘটনাগুলোই ফুটে উঠেছে।। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কার তার দিনলিপি এখন পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক পঠিত বই এবং অনেক চলচ্চিত্র ও নাটকের মূল বিষয় হিসেবেও গৃহিত।

তথ্যসূত্র:

আনা ফ্রাঙ্কের সন্ধানে – মূল আর্নস্ট শ্ন্যাবেল, ভাষান্তর অসীম চট্টোপাধ্যায় ও অজয় চট্টোপাধ্যায়

লেখক: মর্জিনা খাতুন, নারী অধিকার কর্মী

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *