নারী জাগরণে রোকেয়ার চিন্তা ও সংগ্রাম// মর্জিনা খাতুন

“ভগিনীগণ ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন-অগ্রসর হউন ! বুক ঠুকিয়া বল মা ! আমরা পশু নই; বল ভগিনী ! আমরা আসবাব নই; বল কন্যে! আমরা জড়াউ অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্ধুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই, সকলে সমস্বরে বলো আমরা মানুষ!” মানুষ হিসেবে নারীসমাজকে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে দীপ্ত যে চরিত্র তিনিই রোকেয়া। নারী জাগরণের লক্ষ্যে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজের অগ্রগতি নারীর অগ্রগতি ছাড়া সম্ভব হবে না। তাই তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন মুসলিম সমাজে নারীর উপর নির্মম নিষ্ঠুরতা, অবিচার ও পর্দার নামে অবরুদ্ধ জীবনযাপনে বাধ্য নারী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য আজীবন নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি শুধু নারী জাগরণের পথিকৃৎ ছিলেন না। তিনি ছিলেন একাধারে চিন্তাবিদ, সমাজ সংস্কারক, সমাজকর্মী, সংগঠক, কবি, সাহিত্যিক, অনুবাদক ও শিক্ষাবিদ। শিক্ষাকে হাতিয়ার করে তিনি নারী সমাজকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন। আর লেখনীর মাধ্যমে তিনি তৎকালীন সমাজের অচলায়তনকে আঘাত করেছেন। সাহিত্যে নারীদের সমস্যার কথাও তিনি লিখেছেন নির্ভিক চিত্তে। শুধু সমস্যার কথা বলে ক্ষ্যান্ত হননি, নারীদের সংগঠিত করার কাজও করেছেন। ক্ষণজন্মা এই মহীয়সী নারী আজও আমাদের  প্রেরণার উৎস।

এই নির্ভীক সাহসী নারী ১৮৮০ সালে ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামের এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের। মাতা রাহাতুন্নেসা চৌধুরানী। তিন বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে রোকেয়া ছিলেন চতুর্থ। ডাকনাম ‘রুকু’ আর প্রকৃত নাম “রোকেয়া খাতুন”।

তৎকালীন মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েদের কঠোর পর্দাপ্রথা মেনে চলতে হতো। শিশু কন্যাদেরকেও পর্দা করতে হতো। বাড়িতে কোন অতিথি সে নারী বা পুরুষ যেই আসুক, তাঁদের দেখলে পালাতে হতো, লুকাতে হতো বাড়ির কোন গোপন স্থানে। আরবী ও উর্দু ছাড়া কোন বই  মেয়েদের পড়তে দেয়া হতো না। রোকেয়াও সেরকম একটি পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন। বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের ও খলিল সাবেরকে  পিতা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি করলেও মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি কঠোর ছিলেন।  মেয়েদের বাংলা পড়া প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। তবুও বড় বোন করিমুন্নেসা লুকিয়ে বাংলা পড়তে ও লিখতে শিখেছিলেন। সমাজকে উপেক্ষা করে করিমুন্নেসার এই বিদ্যার্জনের চেষ্টার ভয়াবহ পরিণতি হয়েছিল। সমাজপতিদের নিন্দা ও বাক্যবাণে অধীর হয়ে বাবা করিমুন্নেসার পড়া বন্ধ করে দিয়ে ১৪ বৎসর বয়সে বিবাহ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। করিমুন্নেসার এই ঘটনা রোকেয়া জীবনে গভীর রেখাপাত করেছিল। কিন্তু তারপরও রোকেয়া হাল ছাড়েননি। বড় বোন করিমুন্নেসার আগ্রহ ও আধুনিকমনস্ক বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের সাহচার্য ও উৎসাহে রোকেয়া গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শিখেছিলেন।

১৮৯৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট উর্দুভাষী ও বিপত্নীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে রোকেয়ার বিয়ে হয়। তিনি হন “রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন”। সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন মধ্যবয়সী। তাঁর প্রথম স্ত্রীর একজন কন্যা সন্তান ছিল। তবে বিবাহিত জীবনে রোকেয়া সুখী ছিলেন। সুশিক্ষিত, মুক্তমনা ও উদার প্রকৃতির সাখাওয়াত হোসেন শিক্ষার প্রতি রোকেয়ার অনুরাগকে উৎসাহিত করেছিলেন। ইংরেজিতে রোকেয়াকে দক্ষ করার লক্ষ্যে তিনি প্রতিনিয়ত ইংরেজি চিঠি-পত্র লিখতে ও ইংরেজি সাময়িকী পড়তে দিতেন। ফলে ইংরেজি লেখা ও পড়া দু’টোই রপ্ত হয়েছিল রোকেয়ার। রোকেয়া এমন দক্ষ হয়েছিলেন যে, অনেক সময় সাখাওয়াত হোসেনের অফিসের কাজেও সহযোগিতা করতেন। তাঁর জীবিত অবস্থায় রোকেয়া ইংরেজিতে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন,যার নাম ‘ Sultana’s Dream’।  বাংলায় অনুদিত নাম “সুলতানার স্বপ্ন”। এই প্রবন্ধে তিনি নারীর আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাকে উল্লেখ করেছেন এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি তীব্র আঘাত হেনেছেন। এই প্রবন্ধ পড়ে সাখাওয়াত হোসেন মন্তব্য করেছিলেন, “এ এক নিদারুণ প্রতিশোধ।” কারণ এই প্রবন্ধে রোকেয়া পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিপরীত সমাজব্যবস্থার এক চিত্র ফুটে তুলেছিলেন। শুধু তাই নয়, এই প্রবন্ধে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও তার ব্যবহার, রাজনৈতিক অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, জীব-বৈচিত্র ও প্রাণ-প্রকৃতি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। 

রোকেয়া খুব বেশিদিন সাখাওয়াতের সাহচার্য পাননি। তিনি দুরারোগ্য বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হন। দুটি চোখও তাঁর নষ্ট হয়েছিল। বহু চিকিৎসার পরও আরোগ্য লাভ করেননি। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯০৯ সালের ৩রা মে  সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। তখন রোকেয়া সাখাওয়াতের বয়স মাত্র ২৯ বছর। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে শিক্ষার প্রতি রোকেয়ার দুর্নিবার আগ্রহকে জীবন্ত রাখার প্রয়াস থেকে তিল তিল করে গচ্ছিত তৎকালীন সময়ে দশ হাজার টাকা তিনি রোকেয়াকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য এই দশ হাজার টাকাই ছিল রোকেয়ার একমাত্র সম্বল। 

স্বামীর মৃত্যুর পর মহীয়সী রোকেয়ার জীবনে শুরু হল এক নতুন সংগ্রাম। তিনি জীবনের লক্ষ্য স্থির করলেন। আর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তিনি নারীশিক্ষাকে হাতিয়ার করলেন। ঐ বছরেই  ১লা অক্টোবর স্বামীর জন্মস্থান বিহারের ভাগলপুরে মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে প্রথম বার ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করলেন। স্কুল পরিচালনা বিষয়ে অনভিজ্ঞতা থাকা সত্তে¡ও দৃঢ় চিত্তে তিনি স্কুল পরিচালনার কাজ করেছিলেন। কিন্তু ভাগলপুরে বেশিদিন স্কুল পরিচালনা করতে পারলেন না। কারণ সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে সাখাওয়াতের প্রথম পক্ষের কন্যা ও জামাতার সঙ্গে বিরোধের পরিণতিতে কয়েক মাস পরে তাকে ভাগলপুর ছেড়ে স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে আসতে হয়। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতায় এসে ১৩ নম্বর ওয়ালিউল্লাহ লেনে আবার নতুন করে “সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল” শুরু করেন। মাত্র আটজন ছাত্রী আর দুইটি বেঞ্চ নিয়ে। ১৯১৫ সালে স্কুলটিকে তিনি ৮৬ নম্বর  লোয়ার সার্কুলার রোডে স্থানান্তরিত করেন।

এই সময় রোকেয়ার জীবনের গতি মোড় নিল নতুন দিকে। স্কুলের কাজে নিবেদন করলেন জীবনের প্রতিটি মহুর্ত। শিক্ষকতা থেকে শুরু করে ছাত্রী সংগ্রহ, ছাত্রীদের স্কুলে আনা-নেয়া করাসহ সমস্ত কাজ তিনি নিজেই করতেন। তৎকালীন মুসলিম সমাজের রক্ষণশীলতা সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকায় স্কুলের কার্যক্রম সচল রাখার উদ্দেশ্যে সচেতন ও সংবেদনশীল রোকেয়া স্কুলে পর্দার ব্যবস্থা চালু রেখেছিলেন। তারপরও সমাজের একশ্রেণীর রক্ষণশীল মানুষদের শাসানি তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। তারাই বলেছে “রোকেয়া কেন স্কুল করতে চাইছেন? কেন জানো না? অল্পবয়সী বিধবা মেয়ে ইস্কুল গড়ে নিজের রূপ যৌবনের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে! তবে ঐ রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায়ও রোকেয়া সুশিক্ষিত, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কিছু মানুষের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। তাদের মধ্যে স্কুল কমিটির সেক্রেটারী মৌলভী সৈয়দ আহমদ আলী অন্যতম।

রোকেয়ার হাতে গড়া ছোট স্কুল ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছিল। ১৯১৪ সালে স্কুলে ছাত্রী সংখ্যা হলো ঊনচল্লিশজন। ১৯১৫ সালে সত্তরে দাঁড়ালো। এই বছর স্কুল উচ্চ প্রাথমিক শাখার স্বীকৃতি পায়। ১৯২৭ সালে জুনিয়র স্কুলের রূপ লাভ করে। ১৯৩০ সালে স্কুলে বাংলা বিভাগ খোলা হয়। ১৯৩১ সালে এই স্কুলের তিনজন ছাত্রী প্রথম ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নেয়। ১৯৩২ সালে আবার স্কুল স্থানান্তর করা হয় ১৬২ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোডে। তাঁর জীবদ্দশাতেই স্কুলটি প্রথম শ্রেণীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তাঁর মৃত্যুর পর সরকার স্কুলটির দায়িত্বভার গ্রহণ করে এবং স্কুলের নামকরণ করা হয় “সাখাওয়াত মেমোরিয়াল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়”।

নারী শিক্ষা বিস্তারে যেমন তিনি মনোনিবেশ করেছিলেন তেমনি সাহিত্য চর্চাও অব্যাহত রেখেছিলেন। সাহিত্যের মাধ্যমেই তিনি নিজের চিন্তা সমাজে প্রচার করেছিলেন। ‘পিপাসা’ তাঁর প্রথম বাংলা গল্প যার মধ্য দিয়ে  তিনি সাহিত্য জগতে পদার্পণ করেন। মতিচূর-১ম খন্ড (১৯০৪), মতিচূর-২য় খন্ড (১৯২২), অবরোধবাসিনী (১৯৩১) ইত্যাদি বাংলা ভাষায় লিখিত তাঁর গ্রন্থ। এছাড়া ‘পদ্মরাগ’ (১৯২৪) তাঁর লিখিত প্রথম উপন্যাস।  উল্লেখিত রচনাসমূহের মধ্য দিয়ে তিনি ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরেছেন, দেশ, সমাজ ও শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার দিক জোরালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি অনবদ্য কিছু কবিতা ও রম্যরচনাও লিখেছেন।

তিনি অনেক রচনায় তৎকালীন সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে যেসব বক্তব্য তুলে ধরেছেন সেগুলো তাঁর সাহসিকতার পরিচয় বহন করে। ‘দজ্জাল’ নামের গল্পে তিনি “পোলসেরাত” এর নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে উল্লেখ করেছেন,“—মনে করুন, ঐ পোলসেরাত একটি পরীক্ষা বিশেষ। ঐ পরীক্ষায় যে উত্তীর্ণ হয়, সে সিদ্ধি লাভ করে; যে ফেল হয়, তার মনোবাঞ্ছা অপূর্ণ রহিয়া যায়। এই সংসার কি? একটা বিরাট পরীক্ষাক্ষেত্র নহে? মানব-জীবন পোলসেরাতের পথেই চলিতেছে না কি?” অর্থাৎ এই সংসার বা পৃথিবীটিকে তিনি ঐ পোলসেরাতের মত প্রতিটি মানুষের জন্য একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ‘রসনা -পূজা’ প্রবন্ধে রমজান মাসে সংযমের নামে মুসলমান সমাজ খাওয়া-দাওয়ার যে অপচয় করে তাকেই তিনি কটাক্ষ করেছেন। ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষ কিভাবে নারীর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে সে সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “–এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহা উচিত নহে। আরও দেখ, যেখানে  ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, ‘সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। ‘ —- যেখানে ধর্মবন্ধন শিথিল, সেখানে রমনী প্রায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন।”

‘পদ্মরাগ’,‘অবরোধবাসিনী’ ‘ডেলিশিয়া হত্যা’ তিনটি রচনাতেই তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল নারীদের অবস্থা যে একই প্রধানত তাই উল্লেখ করেছেন। “পদ্মরাগ” উপন্যাসে নারীদের সাহস, বুদ্ধি, শিক্ষা ও মর্যাদার বিষয় তুলে ধরেছেন। ‘অবরোধবাসিনী’-তে নারীদের অবরোধপ্রথার হাস্যকর বাড়াবাড়ির ছবি তুলে ধরেছেন। আবার নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারতে সেই সময়ে অনেকে মনে করতেন ইউরোপের মেয়েরা কত স্বাধীন! তাই ইউরোপের নারীদের অবস্থা তুলে ধরার জন্য মেরি করেলির লেখা ইংরেজি উপন্যাসের কাহিনী ‘ডেলিশিয়া হত্যা’ বাংলায় অনুবাদ করেন। এই কাহিনীর শুরুতে তিনি ইউরোপ ও ভারতীয় নারীদের জীবন-চিত্রের পার্থক্য ফুটে তুলেছেন এবং উভয়েই যে সমাজের অত্যাচারে মর্মপীড়িতা তা উল্লেখ করেছেন।

‘মতিচূর’ প্রথম খন্ডের ‘গৃহ’ প্রবন্ধটিতে সমস্ত নারীজাতির অবস্থা উল্লেখ করে তিনি দেখিয়েছেন যে বসবাসের জন্য প্রতিটি নারীর জন্য একটি ঘর থাকা দরকার, সেই ঘরটাও নারীদের নেই। নারীরা অন্যের উপর নির্ভরশীল। ভারতের নারী সমাজের এই দুঃখ-দুর্দশা তিনি দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন আর উচ্চকন্ঠে তা প্রকাশ করেছেন। তাই ১৯২৭ সালে বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতির সভায় সভানেত্রী হিসেবে বক্তৃতাদান কালে তিনি বলেছেন- 

“— আমি আজ ২২ বৎসর হইতে ভারতের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবের জন্য রোদন করিতেছি। ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীব কাহারা, জানেন ? সে জীব ভারত-নারী! এই জীবগুলির জন্য কখনও কাহারও প্রাণ কাঁদে নাই। মহাত্ম গান্ধী অস্পৃশ্য জাতির দুঃখে বিচলিত হইয়াছেন; স্বয়ং থার্ড ক্লাস গাড়ীতে ভ্রমণ করিয়া দরিদ্র রেল-পথিকদের কষ্ট হৃদয়ঙ্গম করিয়াছেন। পশুর জন্য চিন্তা করিবারও লোক আছে, তাই যত্রতত্র ‘পশু-ক্লেশ-নিবারণী-সমিতি’ দেখিতে পাই। পথে কুকুরটা মোটরচাপা পড়িলে, তাহার জন্য এংলো-ইÐিয়ান পত্রিকাগুলিতে ক্রন্দনের রোল দেখিতে পাই। কিন্তু আমাদের ন্যায় অবরোধ-বন্দিনী নারীজাতির জন্য কাঁদিবার একটি লোকও এ ভূ-ভারতে নাই।”

নারী-পুরুষ সম্পর্কের মধ্যে যে বৈষম্য সে সম্পর্কে তিনি অর্দ্ধাঙ্গী প্রবন্ধে লিখেছেন-‘স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থ  সেলাই করিবার জন্য) মাপেন! স্বামী যখন কল্পনা-সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহনক্ষত্রমালা বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্য্যমÐলের ঘনফল তুলাদÐে ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাউল-ডাল ওজন করেন এবং রাঁধুনীর গতি নির্নয় করেন। বলি জ্যোতির্ব্বেত্তা মহাশয়, আপনার পার্শ্বে আপনার সহধর্ম্মিনী কই? ”

নারী-পুরুষের সমমর্যাদা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে সে সম্পর্কে তিনি ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “আমরা সমাজেরই অর্দ্ধঅঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে-একই। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই।”

রোকেয়া শুধু নারী সমস্যা নিয়ে ভাবেননি। সমাজের সমস্যা নিয়েও ভেবেছেন। তিনি ‘চাষার দুক্ষু’ প্রবন্ধে চাষীদের জীবনচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, বয়কট আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন ও চরকা আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলনের উত্তাল সময়ে নারীদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিৎ তা নিয়ে মতামত রেখেছেন। এই সময়ে রোকেয়া ‘সুগৃহিনী’(১৯০৫) প্রবন্ধে আন্দোলনের প্রশ্নে সুগৃহিনীর কর্তব্য কি হবে তার উল্লেখ করেছেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মেয়েরা যোগ না দিলে যে দেশের দুঃখ দূর হবে না-এই বিষয়ে তিনি ‘জ্ঞানফল’ ও ‘মুক্তিফল’ নামক দুইটি রূপক গল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। ইংরেজদের হাত থেকে কুটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে রংপুরের ‘এÐিশিল্প’ বিষয়ে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন। ‘বলিগর্ত’ প্রবন্ধে চরকা এবং ‘সৃষ্টি তত্ত্ব’ প্রবন্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন সম্পর্কে লিখেছেন। আর বিপ্লবী কানাই লালের ফাঁসির আদেশ শোনার পর ‘নিরুপমা বীর’ কবিতাটি রচনা করেছেন। অর্থাৎ প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহে রোকেয়া তাঁর চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।

১৯১৬ সালে মুসলিম নারীদের জন্য ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি’ বা ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমিতির জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি সদস্য সংগ্রহের কাজ করেছেন। প্রথম দিকে নারীদেরকে সমিতিতে আনা কষ্টসাধ্য হলেও পরবর্তীতে একজন একজন করে মেয়ে সমিতিতে আসতে শুরু করে। কিন্তু সমিতিতে  যেসব মেয়েরা আসত তাদের জ্ঞানাভাব এত বেশি ছিল যে, সভা শেষ হওয়ার পর সবাই যখন চলে যাচ্ছে তখন তারা জিজ্ঞেস করত, কই সভা তো হলো না?  এই মেয়েদের কাছে রোকেয়া নারী সমাজের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা  করেছেন। দেশ-বিদেশের নারী আন্দোলনের কথা বলেছেন। সভা কাকে বলে, সমিতির উদ্দেশ্য কি- ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। দুঃস্থ, অত্যাচারিত নারীদের জন্যও এই সমিতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।

মূলত তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন এই সমিতির কাজকর্ম পরিচালনা করেছেন। এছাড়াও ১৯২২ সালে তিনি ‘নারী তীর্থ’ প্রতিষ্ঠানের সভানেত্রী হন। আর বহু সংগঠনে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। এই সমস্ত কাজ পরিচালনা করতে গিয়েও নানা সমালোচনা শুনেছেন। সেজন্য তিনি সমিতির সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেছেন -“যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করে নিতে হবে, যেন নিন্দা-গøানি, উপেক্ষা-অপমান কিছুই তাকে আঘাত করতে না পারে। মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে, যেন ঝড়-ঝঞ্ঝা, বজ্র-বিদ্যুৎ সকলই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে।” তিনি বুঝেছিলেন নারীরা যদি আপন শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়, আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয় তাহলে বাইরের বাধা দূর করা সম্ভব। তাই তিনি ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে নারীদের আহবান করে বলেছেন,

“অতএব জাগ, জাগ গো ভগিনি ! ”

প্রথমে জাগিয়া ওঠা সহজ নহে, জানি; সমাজ মহা গোলযোগ বাধাইবে জানি; ভারতবাসী মুসলমান আমাদের জন্য “কৎল”- এর (অর্থাৎ প্রাণদÐের) বিধান দিবেন এবং হিন্দু চিতানল বা তুষানলের ব্যবস্থা দিবেন, জানি! (এবং ভগ্নিদিগেরও জাগিবার ইচ্ছা নাই, জানি!) কিন্তু সমাজের কল্যাণের নিমিত্ত জাগিতে হইবেই। বলিয়াছি ত কোন ভালো কাজ অনায়াসে করা যায় না। কারামুক্ত হইয়াও গ্যালিলিও বলিয়াছিলেন, কিন্তু যাহাই হউক পৃথিবী ঘুরিতেছে (But nevertheless it (earth) does move)। আমাদিগকেও এইরূপ নির্যাতন সহ্য করিয়া জাগিতে হইবেই।”

অত্যধিক শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের ফলে রোকেয়ার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারী তাঁর কর্মব্যস্ততা থেকে চির পরিত্রাণ লাভ করেন। তবে আগের রাতেও তিনি ‘নারীর অধিকার’- রচনাটি লিখেছেন। সমগ্র নারীসমাজ তথা সমাজের উন্নতির জন্য তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রাম আমাদের আজকের সংগ্রামের জন্য পাথেয়। তাঁর অপূরিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত করার দায়িত্ব আজকের সমগ্র বিবেকবান মানুষের। রোকেয়া যেমন তিল তিল শ্রম দিয়ে অসাধ্য কাজকে সাধ্যে পরিণত করেছেন তেমনি আমাদেরকেও আজকের সমাজের অন্যায়-অবিচার-কুসংস্কার-কুপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। দৃঢ় ও নির্ভীকচিত্তে অবিচল থেকে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। তবেই রোকেয়ার প্রতি আমরা প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন করতে পারব।

লেখক: মর্জিনা খাতুন, নারী অধিকার কর্মী

error: Content is protected !!