কর্মে ও সংগ্রামে রোজা লুক্সেমবার্গ
সম্পাদনা: মর্জিনা খাতুন, নারী অধিকার কর্মী
আজ যার জীবনী লিখছি তাঁর জীবন ছিল বৈচিত্রে ভরপুর। বুদ্ধির তীক্ষœতা, যুক্তির প্রখরতা ও বাগ্নীতায় যিনি ছিলেন অতুলনীয়, তিনিই রোজা লুক্সেমবার্গ। ৫ মার্চ ছিল সেই মহীয়সী রোজা লুক্সেমবার্গের ১৫০তম জন্মদিবস। তাঁর জীবনে কোনো কিছু স্থায়ী হতে পারেনি। সময়ের সাথে প্রয়োজনের নিরিখে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টিয়েছেন। যখন যেটাকে সত্য বলে জেনেছেন তখনই সেটাকে গ্রহণ করেছেন। এজন্য কষ্টও ভোগ করতে হয়েছে। কারণ সত্যকে গ্রহণ করলে কষ্টকর জীবন ব্যতিত ভিন্ন জীবন পাওয়া যায় না। রোজার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
রোজা লুক্সেমবাগের জন্ম ১৮৭১ সালের ৫ মার্চ, জার শাসিত রাশিয়ার পোল্যান্ডের কাছে যামোস নামে একটি ছোট্ট শহরে। ১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারিতে তিনি শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। এই স্বল্প সময়ে তিনি এক অনন্য সাধারণ বিপ্লবী-জীবনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন।
পাঁচ ভাহবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। পারিবারিক নাম ছিল রোজালিয়া লুক্সেমবুর্গ। মা লীন লুক্সেমবার্গ ছিলেন শিক্ষিত ধর্মপ্রাণা নারী। বাবা এডওয়ার্ড লুক্সেমবার্গ জার্মানীর কর্মাশিয়াল স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ছিলেন কাঠ ব্যবসায়ী। কোনও সুনিদিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাধারার সাথে যুক্ত না থাকলেও তিনি স্থানীয় সকল শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক কর্মসূচীতে সক্রিয় ভূমিকা নিতেন। পরিবারে তারা সাধারণতঃ জার্মান ও পোলিশ ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু রোজা রাশিয়ান ভাষাও শিখেছিলেন।
রোজা লুক্সেমবার্গ তাঁর পিতার কাছ থেকে উদার মতবাদ পেয়েছেন, বিশ্বের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ লাভ করেছেন এবং পাশ্চত্য সাহিত্য পাঠ করার প্রেরণাও বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। জাতিতে তারা ইহুদি হলেও তাঁর বাবা ইহুদিদের সমস্ত রকম কুসংস্কার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন।
মাঝে মাঝেই তাঁর বাবা ব্যবসায়ের কাজে ওয়ারশ যেতেন। ১৮৭৩ সালে সন্তানদের ভালো শিক্ষা লাভের সুযোগের জন্য তাঁর বাবা সপরিবার ওয়ারশতে চলে আসে। এখানেই ৫ বছর বয়সে রোজা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অসুস্থতার কারণে তার হিপজয়েন্টে সমস্যা দেখা দেয় এবং তিনি সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। বছর খানেক শয্যাশায়ী থাকার সময়ে তিনি ভালো করে পড়াশোনা করেন। কঠিন এই অসুস্থতায় তাঁর এক পা ছোট হয়ে যায় এবং তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। এই অবস্থাতে তিনি ক্রমাগত পড়াশোনা ও লেখালেখি করতে থাকেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি জার্মান কবিতা ও সাহিত্য পোলিশ ভাষায় অনুবাদ করেন। তাঁর প্রথম সাহিত্য কীর্তি ছোটদের ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। ঐ বয়সে, বাড়ীর পরিচারিকাদের তিনি লেখাপড়া শেখাতে শুরু করেন। শারীরিক অক্ষমতা সত্তে¡ও তাঁর মন ছিলো উৎসাহে ভরপুর এবং মুখ ছিল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যা অন্যদের প্রেরণা যোগাতো। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি ওয়ারশ স¤্রাট উইহেম এর তৃতীয় ওয়ারশ আগমন নিয়ে একটি কবিতা লিখেন যা ছিল একই সাথে শ্রদ্ধা ও ব্যাঙ্গের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। এই কবিতা কিশোরী রোজার সেই বয়সের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর একটি নিদর্শন।
রোজার শিক্ষা জীবন বিভিন্ন দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। ১৮৮৪ সালে রোজা যে স্কুলে ভর্তি হন সে স্কুলে ইহুদির মধ্য থেকে শুধু তাদেরকে ভর্তি করা হত যারা রাশিয়ান ভাষা জানত। মাত্র ১৩ বছর বয়সে রাশিয়ার একটি প্রথম সারির স্কুলে তিনি নিজের জায়গা করে নিতে সক্ষম হন। এরপর খুবই ভালো ফল করে ১৮৮৭ সালে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন। এর জন্য তিনি স্বর্ণপদক পেতেন, কিন্তু তাঁর আগেই অর্থাৎ ১৮৮৬ সাল থেকে রোজা গোপনে প্রলেতারিয়েত পার্টির বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর এই বিদ্রোহী মনোভাবের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে কোন কৃতিত্ব দিতে অস্বীকার করেন।
দু’বছর বাদে ১৮৮৯ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে গ্রেফতারী পরোয়ানা এড়ানোর জন্য তিনি পোল্যান্ড থেকে সুইজারল্যাÐে চলে যান। সুইজারল্যান্ডে তিনি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি রাজনৈতিক অর্থনীতি ও আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৮৯৮ সালে ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন। সেই সময়ে অল্প কয়েকজন ডক্টরেট ডিগ্রী লাভকারী নারীর মধ্যে তিনিও ছিলেন। যখন তিনি জুরিখে ছিলেন, বিদেশ থেকে তিনি তাঁর বৈপ্লবিক কর্মকান্ড চালিয়ে যান। এরই সাথে তিনি জুরিখেও শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। পোল্যাÐ ও রাশিয়ার যে সমস্ত রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা সেখানে জড়ো হতেন তারা নিয়মিত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে একত্রে মিলিত হয়ে আলোচনা করতেন, তাদের আলোচনার বিষয় থাকত বৈচিত্রপূর্ণ, যেমন বিপ্লবী দর্শন, ডারউনিজম, মেয়েদের মুক্তি, মার্ক্স, টলস্টয়, কম্যুনিজম, পুঁজিবাদের অগ্রগতি, বিসমার্কের পতন, নিহিলিয়ান সন্ত্রাসবাদ, অথবা বিপ্লবী সংগ্রামের পদ্ধতি কি হবে ইত্যাদি। রোজা মার্ক্স বাদকেই একমাত্র পথ বলে মনে করতেন। তিনি ছিলেন একাধারে মার্ক্সবাদী, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, যুদ্ধ-বিরোধী সংগঠক ও বিপ্লবী।
ঐ সময়ে রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সাথে আলাপ হয়। প্লেখানভ ছিলেন ঐ পার্টির নেতা। অল্পদিনের মধ্যে লুক্সেমবার্গের সাথে রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সাথে তীব্র তাত্তি¡ক পার্থক্য তৈরি হয়, প্রাথমিকভাবে পোলিসদের স্ব-নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তিনি মনে করতেন, এই স্ব-নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে দুর্বল করবে। তাঁর এই বিষয়ে মতামত রাশিয়া ও পোলিস- দুই সোশাল ডেমোক্রেটিক দল থেকে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় এবং এক সময়ে বিরোধীতার ফলে লুক্সেমবার্গ ১৮৯৩ পোলিস সোশাল ডেমোক্রেটিক দল গঠন করেন। এই সময় লুক্সেমবার্গ তাঁর জীবনের দীর্ঘ সঙ্গী নিও জোগিসাস-এর সাথে মিলিত হন, তিনি ছিলেন পোলিস সোস্যালিস্ট দলের প্রধান। লুক্সেমবার্গ নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতায় পোলিস স্যোসাল ডেমোক্রেটিক পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃত হন এবং মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি এর সাথে যুক্ত ছিলেন। রোজার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্লারা জেটকিন জোগোসিস সম্পর্কে বলেন, উনি পুরুষদের মধ্যে একজন বিরল চরিত্রের মানুষ যিনি একজন নারীর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে অবিচ্ছেদ্য বন্ধত্ব গড়ে তুলেছিলেন। রোজা ছিলেন অত্যন্ত সুবক্তা ও তাত্তি¡ক। অনেক বিষয়ে তিনি লিখে গিয়েছিলেন। আন্ডারগ্রাউÐে থেকে জোগোসিসের সাথে কাজ করেছেন। রোজা ও লিও জোগোসিসের ভূমিকা পোল্যান্ডের সাম্যবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
তাঁর প্রথম জীবনের সংগ্রাম হিসেবে পোলিশ স্যোসালিস্ট পার্টি (পিপিএস) গড়ে ওঠে। পিপিএস এর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে তিনি ১৮৯৩ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে যোগ দেন। নিজের যুক্তিতে তিনি থাকতেন অটল, স্থির বিশ্বাসের সাথে সমস্ত আলোচনার অংশীদার হয়ে তিনি নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করতেন। এরই ফলে ১৮৯৬ সালে চতুর্থ আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে তাঁর প্রতিনিধিত্ব ছিল সর্বজনস্বীকৃত।
ইতিমধ্যে তিনি পড়াশোনা সমাপ্ত করে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। জার্মান স্যোসালিস্ট পার্টির সাথে ঘনিষ্টভাবে কাজ করার আগ্রহে তিনি জার্মানীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেন। লুক্সেমবার্গ ১৮৯৮ সালে জুরিখ থেকে বার্লিনে যান এবং জার্মান সোশাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির কাজে যোগ দেন। এই সময়ে তিনি থাকতেন কার্ল রুবেক ও অলিম্পিয়া রুবেক নামে এক জার্মান দম্পতির আশ্রয়ে । এই কার্ল রুবেক নিজে প্রতিবন্ধি ছিলেন। তিনি বিপ্লবী কর্মকাÐের সাথে যুক্ত থেকে নানান লেখা প্রকাশ করেছেন। কার্ল লেখালেখি ও অলিম্পিয়া বিপ্লবী কাজে রোজাকে সাহায্য করতেন এবং তারা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। এই পরিবারের গুস্তভ লুবেককে রোজা বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ জার্মান নাগরিকত্ব ছাড়া রাজনৈতিক কাজ করা ছিল দুঃসাধ্য। এতে করে তাঁর জার্মান নাগরিকত্ব পেতে আর কোনও বাধাই থাকবে না, এবং জার্মান সরকার তাঁকে রাজনৈতিক কাজেও বাধা দিতে পারবে না। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও তারা দাম্পত্য জীবনে ছিলেন না। পাঁচ বছর পর যখন তিনি জার্মান নাগরিকত্ব পেয়ে যান তখন লুবেকের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ করেন।
জার্মান স্যোসালিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হওয়ার পর দ্রæতই তাঁর বৈপ্লবিক কার্যকলাপ এবং লেখার কাজ বেড়ে চলে। এই পার্টির নারী শাখার প্রধান ক্লারা জেটকিনের সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব হয় যা মৃত্যুর দিন পর্যন্ত অটুট ছিল। দু’ জনের বন্ধুত্ব সমাজতান্ত্রিক নারী শ্রমিক আন্দোলন ও নারী আন্দোলনকে বেগবান করেছিল। তাঁদের দু’জনের বন্ধুত্ব এখনও আমাদের প্রেরণার উৎস। দু’জনে আজীবন সমাজতান্ত্রিক চিন্তাকে এগিয়ে নিতে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করেছেন। নারী দিবসের আন্দোলনে তাদের দু’জনের ভূমিকা স্মরণীয়।
১৮৯৮ সালে তিনি বার্নস্টাইনের মার্ক্সবাদী তত্তে¡র সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে ‘বিপ্লবের সংস্কার’ রচনা করেন। ১৯০০ সালে ইউরোপের সমসাময়িক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এ সময়ে তিনি জার্মান সামরিক হস্তক্ষেপ ও সা¤্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমাতœক বক্তব্য রাখেন। জার্মান সোশালিস্ট দলে মার্কবাদকে শোধনবাদের হাত থেকে রক্ষা করতে, ১৯০৪ সালে – ‘সোশাল ডেমোক্রেসি এবং পার্লামেন্টীয়বাদ’ রচনা করেন। ১৯০৫ সালে রাশিয়ার বিপ্লবের পরে, লুক্সেমবার্গ তাঁর মনোযোগ রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে নিবন্ধ করেন। তিনি রাশিয়ার মেনশেভিক এবং সোস্যালিস্ট দলগুলোর বিরুদ্ধে এবং বলশেভিক পার্টির সমর্থনে দাঁড়ান। ওয়ারস- তে রাশিয়ার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে সাহায্য করার কার্যাবলী গ্রহণের জন্য তিনি কারাবন্দী হন। ১৯০৪ এবং ১৯০৬ সালের মধ্যে তিনি তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য মূলত কারাবন্দীই ছিলেন। ১৯০৬ সালে তিনি রচনা করেন পুঁজির ‘পুঞ্জীভবন’ -এখানে সাম্রাজ্যবাদের দিকে ধনতন্ত্রের গতিকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন।
১৯০৭ সালে তিনি লন্ডনে ‘রাশিয়ান সোশাল ডেমোক্রার্টিক পার্টি’র সভায় যোগ দিতে যান, যেখানে ভøাদিমির লেনিনের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। স্টুটগার্টের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কংগ্রেসে রোজা শ্রমিক শ্রেণীর সমস্ত ইউরোপীয়ান পার্টিগুলোকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য যে প্রস্তাব দেন তা গৃহিত হয়।
তিনি ১৯১২-১৯১৪ সাল পর্যন্ত যুদ্ধবিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকেন এবং ফ্রাংকফুটে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশের ডাক দেন এবং সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহবান করেন। এজন্য তিনি এবং কার্ল লিবনেক্ট গ্রেফতার হন। এছাড়াও রোজা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে ধর্মঘট আহŸান করার জন্য জার্মান সোশালিস্ট ডেমোক্রেটিক (এসপিডি) পার্টিকে প্রস্তাব দেন। কিন্তু এসপিডি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর অংশগ্রহণকে সমর্থন করে।
ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরে লুক্সেমবার্গ জার্মান সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ত্যাগ করেন। এরপর ১৯১৪ সালের আগস্টে কার্ল লিবনেখট, ক্লারা জেটকিন এবং ফ্রাঞ্চ মেহরিং মিলে আন্তর্জাতিক দল ‘স্পাটাকার্স লিগ’-এর জন্ম দেন। ১৯১৬ সালের জুন মাস থেকে ১৯১৮ সালের ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁর জীবন ছিল কারারুদ্ধ। যাতে তিনি কোনও রকম রাজনৈতিক কর্মকাÐে যোগ দিতে না পারেন, এমনকি রাজনৈতিক বিষয়ে কোনও লেখাও না লিখতে পারেন । সেই সময় এই অসীম ধীশক্তি ও প্রাণশক্তিসম্পন্ন মানুষটির হৃদয়াবেগ প্রকাশের একমাত্র পথ ছিল পরিচিতদের কাছে চিঠি লেখা। এছাড়াও কারাবন্দী অবস্থায় তিনি ‘জুনিয়াস প্যামফ্লেট’ রচনা করেন, যা স্পার্টাকাস লিগে’-র তাত্তি¡ক ভিত্তি হয়ে ওঠে। এই সময় তিনি তাঁর খুব বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ রাশিয়ার বিপ্লব’ রচনা করেন- এখানে তিনি ‘প্রলেতারীয় একনায়কত্ব’ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। । ১৯১৮ সালে ৮ নভেম্বর জেল থেকে ছাড়া পাবার পর ‘রেড ফ্লাগ’ নামক একটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। এই পত্রিকায় তিনি ’ক্যাপিটাল পানিশমেন্টে’র বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধ লেখেন এবং সমস্ত রাজবন্দীদের সাধারণ ক্ষমার দাবি করেন। সেখানে তিনি বুর্জোয়া বিচার ব্যবস্থার নিষ্ঠুরতার দিক সম্পর্কে কষাঘাত করেন এবং মৃত্যুদÐ বাতিলের দাবি করেন।
১৯১৮ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর তিনি স্পার্টাকার্স লীগের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ২৯-৩১ ডিসেম্বর তিনি স্পাটাকার্স লীগের যুক্ত কংগ্রেস আহবান করেন যেখানে ইনন্ডিপেন্ডন্ট সোশালিস্ট ও দি ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিস্ট পার্টি অব জার্মানী যোগ দিয়েছিল। কার্ল লিবনেক্ট ও রোজা লুক্সেমবার্গের নেতৃত্বে ১লা জানুয়ারি ১৯১৯ সালে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি ওয়েমার রিপাবলিকের প্রতিষ্ঠিত ‘ওয়েমার ন্যাশনাল এসেম্বলীতে’ যোগ দেয় কিন্তু ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার না থাকায় তারা এই নির্বাচন বয়কট করে।
জীবনের শেষ দুটি মাস অর্থাৎ ৯ ই জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি অক্লান্ত দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রমের মধ্যে কাটিয়েছেন। এই দুটি মাস প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিকের বিক্ষোভ মিছিল ছিল। এই বিক্ষোভ ছিল সরকার বিরোধী ও শ্রমিক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। প্রতিদিনই অসংখ্য জনসভা অনুষ্ঠিত হতো। এসব সমাবেশে রোজা বক্তব্য রাখতেন।
শ্রমিক বিক্ষোভের সাথে রোজা পুঁজিবাদ ধ্বংস করে বিপ্লব সংঘটিত করার ডাক দেয়। ‘রেড ফ্লাগ’ পত্রিকার মাধ্যমে বিপ্লবের পক্ষে প্রচারনা শুরু করে এবং শক্রদের সাথে কোনো প্রকার আপোষরফা হবে না এই মর্মে বিবৃতি দেন। ১১ জানুয়ারি যখন বিদ্রোহ তুঙ্গে তখন জার্মান চ্যাঞ্চেলর ও জার্মান সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টি যৌথভাবে আন্দোলনকারীদের আন্দোলন বানচাল করার জন্য সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে। রোজা শেষ ভাষণ দেন ১৫ জানুয়ারী ১৯১৯, জার্মান কমিউনিষ্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা সমাবেশে। এ সমাবেশ থেকে তিনি ও তাঁর সহকর্মী লিবনেক্ট গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পর তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। এরপর নিষ্ঠুর ভাবে তাদের হত্যা করা হয় এবং তাঁদের লাশ ল্যান্ডারক ক্যানেলে নিক্ষেপ করা হয়।
রোজা একদিকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দলের অভ্যন্তরে সঠিক সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন অন্যদিকে নারীদের সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধেও লড়াই করেছেন। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তার কাজেও বাধা সৃষ্টি করেছিল। জার্মান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকের তদানীন্তন নেতৃত্ব চেষ্টা করেছিলেন তাকে পার্টির নারী শাখার কাজে যুক্ত করতে। এর দ্বারা তাঁকে কিছুটা অন্তরালে সরিয়ে দেয়ায় ছিল মূল লক্ষ্য। একারণেই আন্তর্জাতিক প্যারিস কংগ্রেসে তাকে বাদ দেবার ব্যর্থ চেষ্টা হয়। রোজা এই সমস্ত হীন আক্রমনকে বরাবর উপেক্ষাই করে গেছেন। শত্রæপক্ষের কুৎসা, কুৎসিত নোংরা আচরণ তাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতো না। তাঁর ব্যঙ্গাত্মক ক্ষুরধার যুক্তিজাল ছিল সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর স্থাপিত।
জার্মান সোস্যালিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে বিপ্লবী আন্দোলনে মেয়েদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে তিনি লড়াই করেছেন। তিনি বলেছেন নারীর মুক্তি একমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়েই সম্ভব। তিনি নারীদের সমাজের অন্যান্য শোষিত নিপীড়িত জনগণের অংশ বলে মনে করতেন। আর তাই নারীদের সরাসরি বিপ্লবী আন্দোলনে আসার জন্য আহ্বান জানিয়ে গেছেন। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে ‘প্রলেতারিয়েত নারী ‘ প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন যে, “নারীরা সমস্ত কাজেই পুরুষের সাথে সমানভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে, পুরুষের মতো একই অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করে, একই ভাবে পুঁজির জন্য দাসত্ব করে, একইভাবে রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে চলে এবং তার দ্বারা রক্তহীন হয়ে পড়ে এবং দমিত হয়। নিজেদের রক্ষা করার জন্য তার একই ধরনের স্বার্থ আছে এবং একই ধরনের অস্ত্র সে তুলে নেয়। তার রাজনৈতিক দাবিসমুহ সমাজের গভীরে প্রোথিত রয়েছে, যা শোষক শ্রেণি থেকে শোষিত শ্রেণিকে পৃথক করে দেয়, তা নারী এবং পুরুষের মধ্যে বিরোধ নয়, পুঁজি ও শ্রমের বিরোধের মধ্য দিয়ে।”
রোজা লুক্সেমবাগের জীবন ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার বিস্তার ও নারী আন্দোলনে তিনি উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন। মাথা উচুঁ করে যুক্তিসঙ্গত লড়াইয়ে তিনি কখনও পিছুপা হননি। আজকের যুগে বিপ্লবী আন্দোলনে তাঁর মতো নারী সংগঠক ও নেতৃত্বের অভাব লক্ষণীয়। এই মহীয়সী রোজার কাছ থেকে আমাদের শিক্ষনীয় হলো-যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুক্তি, প্রজ্ঞা ও মর্যাদার সাথে লড়াইয়ে যুক্ত থাকা। তাই ২০২১ সালের নারী দিবসে তাঁর সংগ্রামী জীবন-গাঁথাকে সমস্ত নারীর জন্য প্রেরণার উৎস হবে সেটার প্রতাশ্যা রইল।
উৎসসমুহ:
- মার্কসীয় বীক্ষায় নারীমুক্তি -সম্পাদনা রূপা আইচ
- দেশ-বিদেশের সংগ্রামী নারী -অল ইন্ডিয়া মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন
- উইকিপিডিয়া