ইয়াসমিন আজও নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক
মর্জিনা খাতুন, নারী অধিকার কর্মী
ইয়াসমিন শুধু একটি নাম নয়, একটি প্রতীক। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিদ্রোহের মূর্ত প্রতীক ইয়াসমিন। এই বিদ্রোহ শুধু ইয়াসমিনের জন্য ছিল না, ছিল ইয়াসমিনের মতো হাজারো ধর্ষণের শিকার-নির্যাতিত-নিপীড়িত নারীর জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার একটি বিদ্রোহ। সমাজ অভ্যন্তরে যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শক্তি দানা বাধে তখন তা বিদ্রোহের সৃষ্টি করে। আর এ বিদ্রোহ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সরকারের পেটোয়া বাহিনী পুলিশ কর্তৃক ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে দিনাজপুরে যে গণঅভ্য্যুত্থানের সৃষ্টি হয়েছিল সেটি ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের শক্তি। সমাজের একদিকে থাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী একদল মানুষ, তার অপরদিকে থাকে অন্যায়কে আশ্রয়-প্রশয়দানকারী শাসকদল ও তার সমর্থনপুষ্ট একদল মানুষ। পুলিশ কর্তৃক ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের দাবিতে যখন দিনাজপুরবাসী ফুঁসে উঠেছিল সেদিনও শাসকশ্রেণিসহ একশ্রেণির পাষণ্ড অন্যায়কে ধামা-চাপা দেয়ার জন্য ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ন্যায়ের পক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তা করতে দেয়নি। তাই চৌদ্দ বছরের কিশোরী ইয়াসমিন হয়ে ওঠেছিল ‘সাত ভাই চম্পা’। সেদিন ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে শাসকশ্রেণির দমন-পীড়নে সাত জন ভাই শহীদ হন। সাত ভাইয়ের প্রাণের বিনিময়ে মৃত ইয়াসমিন সপ্রাণ হয়ে উঠে দিনাজপুরবাসী তথা সারাদেশের বিবেকবান মানুষের মাঝে। তাই আজও ইয়াসমিন আমাদের মাঝে বেঁচে আছে নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন বিরোধী আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক হিসেবে।
২৪ আগস্ট, ১৯৯৫। এই দিন ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে দিনাজপুরের দশমাইল নামক স্থানে ইয়াসমিনকে নাইটকোচের সুপারভাইজার ও হেলপার রাত সাড়ে তিনটায় নামিয়ে দেয়। ভোরের অপেক্ষায় দশমাইল বাজারের এক চায়ের দোকানে ইয়াসমিন অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু টহলরত তিন পুলিশ সদস্য (কনস্টেবল অমৃতলাল, এএসআই ময়নুল, সিপাহী আব্দুস সাত্তার) তাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য পিকআপ ভ্যানে ওঠতে বলে। ইয়াসমিন ইতস্তত করলে গাড়িচালক কনস্টেবল অমৃতলাল ধমক দিয়ে ইয়াসমিনকে ভ্যানে ওঠতে বলে। পুলিশ ভ্যান দিনাজপুরের দিকে রওনা দেয়ার পর ৩৫০/৪০০ গজ দূরে সাধনা আদিবাসী বিদ্যালয়ের সামনে পুলিশ ভ্যান দাঁড়ায়। পুলিশ ভ্যান থেকে একটি মেয়ে পড়ে গেছে। তাকে পুলিশ খুঁজছিল। কিছু সময় খোঁজার পর পুলিশ ইয়াসমিনকে খুঁজে পায়। আবার তাকে ভ্যানে তুলে নেয়। ইয়াসমিন প্রাণ বাঁচানোর জন্য পুলিশ ভ্যান থেকে লাফ দিলেও বাঁচতে পারেনি। পুলিশ ভ্যান থামার এই দৃশ্য স্থানীয় বাসিন্দারা পর্যবেক্ষণ করেছিল। পুলিশ ভ্যান চলে গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা সেখানে গিয়ে ভাঙা চুরি, হাতপাখা আর ইয়াসমিনের স্যান্ডেল দেখতে পায়। এরপর ভোর ৫ টার দিকে গোবিন্দপুরে পথের পাশে ইয়াসমিনের লাশ পাওয়া যায়। তিন পুলিশ সদস্য পালাক্রমে ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর গলাটিপে হত্যা করে তাকে ফেলে রেখে যায়।
এই ঘটনায় সেদিন দশমাইলে ভোর শুরু হয়েছিল ভিন্নভাবে। রক্তাক্ত ইয়াসমিনের লাশ দশমাইলবাসী বহন করতে পারছিল না। এক অদ্ভুদ অনুভূতি তাদের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল। রক্ষণকারী পুলিশ যখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ তখন এর পাশবিকতা ও নৃশংসতা দশমাইলবাসীর কাছে ছিল অসহনীয়। ইয়াসমিন যেমন তীব্র যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিল দশমাইলবাসীও ইয়াসমিনের মতো কাতরাচ্ছিল । ইয়াসমিনের শরীর যেমন ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল তেমনই ক্ষত-বিক্ষত বোধ করছিল দশমাইল তথা দিনাজপুরবাসী। ফলে ২৪ আগস্ট ভোর থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। ২৭ আগস্ট সৃষ্টি হয় এক গণঅভ্যুত্থানমূলক পরিস্থিতির। প্রাণ হারায় কাদের, সামু, সিরাজসহ মোট ৭ জন। ২৮ আগস্ট সৃষ্টি হয় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির। অচল হয়ে পড়ে সমস্ত প্রশাসন। জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য সেই সময় সরকার ইয়াসমিন সম্পর্কে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রচার করে। অপরাীদের বাঁচাবার লক্ষে ইয়াসমিনকে পতিতা বানাবার চেষ্টা করে প্রশাসন। সরকারের পক্ষ থেকে মিথ্যা প্রেসনোট জারি করে। ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার সাথে সরাসরি ভ্যানের তিন পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলেও, পুরো প্রশাসনেই সেদিন ধর্ষক ও হত্যাকারীদের মদদ দানে ভূমিকা পালন করেছিল।
দিনাজপুরবাসীর এই আন্দোলনের সাথে সংগতি জানিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন সারাদেশের বিবেকবান মানুষ, বুদ্ধিজীবী, লেখক-সাংবাদিক-আইনজীবী-প্রগতিশীল রাজেনৈতিক দল সহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। ফলে আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। সম্মিলিতি নারী সমাজ এই আন্দোলনের সমর্থনে ঢাকাসহ সারাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে। ৩০ অক্টোবর ১৯৯৫ সালের ঢাকায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে সম্মিলিত নারী সমাজ ২৪ আগস্টকে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয় এবং দিনাজপুরের গণবিদ্রোহে যারা প্রাণ হারিয়েছিল তাঁদেরকে ‘শহীদ’ বলে ঘোষণা করে। সেই ঘোষণার প্রেক্ষিতে আজও ২৪ আগস্টকে আমরা ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করছি।
তখন তীব্র আন্দোলনের ফলে সরকার বাধ্য হয়ে ২৯ ডিসেম্বর ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলাটির তদন্তভার ন্যস্ত করে সিআইডি বগুড়া জোনের সিনিয়র এএসপি মাহফুজুর রহমানের ওপর। তদন্ত শেষে ৯ জনকে আসামী করে ১৯৯৬ সালের ২৪ মে পুলিশ সদর দফতরে মামলাটির চার্জশীট দাখিল করে। দু’বছর ৬ দিন পর ১৯৯৭ সালের ৩১ শে আগস্ট এই মামলার রায় ঘোষণা করেন রংপুর দায়েরা জজ। তিনজন পুলিশের ফাঁসির আদেশ হয়। রায় ঘোষণার ৭ বছর পর ২০০৪ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর ফাঁসি কার্যকর হয় এএসআই মইনুল ইসলাম ও সিপাহী আব্দুস সাত্তারের । অমৃতলাল বর্মনের ফাঁসি কার্যকর হয় একই বছরের ২৮ সেপ্টেম্ববর। এই প্রথম অপরাধী হিসেবে পুলিশ সদস্যদের ফাঁসি হয়। কিন্তু ঘটনাকে যারা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল পুলিশের সেই উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষদের বিচার হয়নি। তারা রয়ে গেল ধরাছোঁয়ার বাইরে। আপাতত দৃষ্টিতে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার বিচার আমাদের মাঝে আশার প্রদীপ জ্বালালেও সমাজ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বড় অপরাধী রয়ে গেল যা আজও আমরা উপলব্ধি করছি।
ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ২৫ বছর পার হলেও থামেনি নারী ধর্ষণ-হত্যা-নির্যাতন-খুন। নির্যাতিতের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। অসংখ্য নাম যুক্ত হয়েছে এ তালিকায়। পুলিশী হেফাজতে চট্টগ্রামে সীমা চৌধুরী হত্যার বিচার হয়নি। হিল উইমেন ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমা এখনো নিখোঁজ। গাইবান্ধার ফুটফুটে তৃষা, নারায়ণগঞ্জের চারুকলার ছাত্রী সিমি, অথবা ইলোরা, রেশমা, পিংকী, সুমাইয়া, রুনা আক্তার, সবিতা চাকমা— আর কত নাম! সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রী খাদিজার ক্ষতবিক্ষত শরীরের ছবি এখনো আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে। কুমিল্লার সুরক্ষিত ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সোহাগী জাহান তনু ধর্ষণ ও হত্যার বিচার এখনো ঝুলছে, পরিবারের সদস্যরা এখনো কাঁদছে। ফেনীতে যৌন হয়রানির শিকার, পরে অগ্নিদগ্ধ ও হত্যা শিকার নুশরাত জাহান রাফীর বিচারে ১৬ জনের ফাঁসির রায় হলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। এখনো নুশরাতের পরিবার নিরাপাত্তাহীনতায় ভুগছে। অগণিত নারীর মৃত্যুর মিছিল আজও অব্যাহত আছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে ১০৪৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে যা ছিল ৭৩২ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে ১০ জন নারীকে। আর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ৪,৬২২ জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৭০৩ জন। ধর্ষণ চেষ্টার শিকার ২৪৫ জন।
২৪ আগস্ট ২০২০। চলছে করোনা দুর্যোগ ও বন্যা। এই দুর্যোগ আমাদের সকলের জীবনকে কম-বেশি বিপন্ন করে তুলেছে। তবে সবচেয়ে বিপন্ন বোধ করছে নারী ও শিশু। এই সময় নারী নির্যাতন বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। শারীরিক-মানসিক যৌন ও আর্থিক নির্যাতনের সাথে সাথে গৃহে স্বামী কর্তৃক নারী নির্যাতনও বেড়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে শুধু জানুয়ারি-জুলাই ২০২০ পর্যন্ত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৪১ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৮ জনকে, ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে ১৬৫ জন। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ৮ জন নারী। এছাড়া স্বামী কর্তৃক খুন হয়েছে ১৩৯ জন নারী। যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৬০ জন নারী, যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ৪৮ জন নারীকে । নারীর সাথে সাথে শিশু নির্যাতন ও বাল্যবিবাহও বেড়েছে। শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৮৪৫ জন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজিএফ) জরিপমতে, শুধু জুন মাসে ৪৬২টি কন্যাশিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে ২ হাজার ৮৯৬টি শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। নারীর উপর এই সহিংসতাকে নারী অধিকার কর্মীরা ‘শ্যাডো প্যানডেমিক’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা দুর্যোগকালে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা শুধু ব্যক্তি, পরিবার বা সমাজ ধারণ করে না, প্রথা, প্রতিষ্ঠান, রীতি-নীতি, আইন, সরকার ও রাষ্ট্র নিজেও ধারণ-লালন-পালন ও পৃষ্ঠপোষকতা করে। ফলে নারী ও শিশু ধর্ষণ-হত্যা-সহিংসতা-নির্যাতন-নিপীড়নের বিচার যত দ্রুত হওয়া উচিৎ তা হয় না। বরং উল্টো নারীর উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা চলে। ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার বিচারে আমরা তা বিশেষভাবে দেখেছি। একই ভাবে তনু ও নুশরাত হত্যার বিচারেও পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা ও শাসকশ্রেণির ভূমিকা বিশেষভাবে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন থামেনি। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়নি। সরকার ও প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে অপরাধী সবসময় অন্তরালেই থেকে যায়। তাই নারী ও শিশু নির্যাতনের সুষ্ঠু বিচার পেতে হলে সমাজের বিবেকবান মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে, যেমন করে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে দিনাজপুরবাসী সহ সারাদেশের বিবেকবান মানুষ সোচ্চার হয়েছিল।