অভিভাবক ও প্রতিপালন আইনে বাংলাদেশের নারীরা কি সন্তানের প্রকৃত অভিাভাবক

গল্পের  শুরুটা কিভাবে হবে তা চিন্তা করতেই মনে পড়ল, এক মায়ের কথা। মা শিক্ষিত, বিদুষী। লড়াকু। চাকুরী করেন। পরিবারের দায়িত্ব পালন করেন। শারীরিক, আর্থিক, মানসিক সব দিক দিয়ে তিনি পারিবারিক বন্ধনে আবেগে-ভালোবাসায় নিজেকে জড়িয়েছেন। সন্তান গর্ভে ধারণ, জন্মদান, দুগ্ধদান এটি শুধুমাত্র মাতারই কাজ। এরপর তার লালন-পালন ও অনিদ্রার বেশিরভাগ দায়িত্ব মায়ের জন্য নির্ধারিত। এত কিছুর পরও আইনানুসারে মা সন্তানের অভিভাবক হতে পারবেন না। এই স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনে দায়িত্ব পালনের পরও যখন একজন মা সন্তানের সন্তানের অভিভাবক হতে পারেন না, তাহলে যেখানে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজমান সেখানে কি একজন মা সন্তানের অভিভাবক হতে পারেন?

অভিভাবক ও প্রতিপালন আইন কি বলে? 

ধরা যাক, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হলো, তাহলে কে হবেন সন্তানের অভিভাবক? অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০-এর ১৯(খ) ধারা অনুসারে কোনো নাবালক সন্তানের বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় অন্য কারো পক্ষে সেই নাবালকের অভিভাবক হওয়া সম্ভব নয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হতে পারে।  সন্তানের প্রকৃত অভিভাবক যিনি তিনি যদি সন্তানকে ঠিকমত দেখাশোনা না করেন বা সন্তানের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বা সন্তানের কল্যাণে আগ্রহী নন; এরূপ ক্ষেত্রে মা নিজ সন্তানের কল্যাণার্থে তার কাছে সন্তান থাকা উচিৎ, এই মর্মে আদালতে আবেদন করতে পারবেন সন্তানের জিম্মাদারিত্বের জন্য। বাবা কিন্তু অভিভাবক। যেখানে পিতা স্বাভাবিকভাবে সন্তানের অভিভাবক, মাতা কেন স্বাভাবিক ভাবে অভিভাবক হতে পারবেন না ?  আদালতের দ্বারস্থ কেন হতে হবে? মা-বাবা সন্তানের অভিভাবক, এটাই  তো স্বাভাবিক। এই আইনে মা শুধুমাত্র সন্তানের জিম্মাদার।

১৮৯০ সালের অভিভাবক ও প্রতিপালন আইনের ৪(২) ধারা অনুসারে, অভিভাবক বলতে সেই ব্যক্তিকে  বুঝায়, যে ব্যক্তি কোনো নাবালকের শরীর অথবা সম্পত্তি অথবা শরীর ও সম্পত্তি উভয়ের তত্ত্বাবধানের জন্য নিযুক্ত হন। আর জিম্মাদরিত্ব” বলতে একটি নিদিষ্ট বয়স পর্যন্ত সন্তান লালন-পালন, রক্ষণাবেক্ষণ, সার্বক্ষনিক দেখাশোনা করার অধিকারকে বুঝায়।  এই আইনে বাবা সন্তানের প্রকৃত আইনগত অভিভাবক, মা সন্তানের জিম্মাদার।  মা সাত বৎসর পর্যন্ত ছেলে সন্তানকে ও বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত মেয়ে সন্তানকে কাছে রাখতে পারবেন। এই অধিকারকে বলে ’হিজানা’ বা জিম্মাদারিত্ব।

নারীর সমানাধিকার কি উপেক্ষিত থাকবে ?

তিল তিল শ্রম দিয়ে সন্তানের জন্য দায়িত্ব পালন করেও সেই সন্তানের অভিভাবকত্ব রাষ্ট্রীয় আইনে মা পাবেন না।  এই ধরণের বৈষম্যমূলক আইন এখনো টিকে আছে ? এই আইনটি ব্রিটিশ আমলের। প্রায় ১৩৪ বছর আগের আইন। তৎকালীন সময়ে মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষার প্রচলন ছিল না বললেই চলে। নারী জাগৃতির পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার হাত ধরে মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়েছিল। “সুলতানার স্বপ্ন” প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া দেখিয়েছিলেন নারীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক হবেন, রাজ্য শাসন করবেন। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা এর সবকটি পেশায় নারীকে দেখতে পাই। কিন্তু  যখন আইনের কথা বলি তখন নারী-পুরুষের বৈষম্য দৃশ্যমান। নারীর চলার পথ সংকটাপন্ন। এগিয়ে গিয়েও নারী পিছনে। সব দায়িত্ব পালনের পরও নারী শুধু সন্তানের অভিভাবকত্ব পেতে ব্যর্থ।

এই আইন বৈষম্যমূলক  

১৮৯০-এর অভিভাবক ও প্রতিপালন আইনের ১৯(খ) ধারাটি সংবিধানের ২৬, ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।  সংবিধানের তৃতীয় ভাগ ” মৌলিক অধিকার”-এর শুরুতেই ২৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,  মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ  কোনো আইন করা যাবে না। [১][২] আর যদি করা হয়, তবে তা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে,  মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী পূর্বেকার সকল আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। কিন্তু  এই আইনের ১৯ (খ) ধারা সাংঘর্ষিক হওয়ার পরও তা বাতিল হয়নি, সংস্কারও হয়নি।

সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। কিন্তু উপরের ১৯(খ) ধারা মতে, নারী-পুরুষ আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় পাবে না। কারণ মাতা হিসেবে নারী এই আইনে উপেক্ষিত।

সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ-নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।”  আইনটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, এতে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করা  হয়েছে।

আইনের পরিবর্তন এখনই প্রয়োজন 

এই আইনটি গোটা ভারতবর্ষের জন্য প্রণীত হয়েছিল। ভারত সরকার  নারী – পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য দূর করে সমতা আনার লক্ষ্যে ২০১০ সালে এই আইনের ১৯ (বি) সংশোধন করে পিতা ও মাতাকে অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।  পাকিস্তান ১৯৮১ এবং ২০২০ সালে অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন দুইবার সংশোধন করে  সস্তান হেফাজতে মায়ের অধিকার বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর পরও আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক আইন পরিবর্তন, সংশোধন ও পরিমার্জন করা হলেও অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইনে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। নারীর সমানাধিকারের প্রশ্ন আসলেই বার বার উপেক্ষিত থেকে গেছে। নারীর অধঃস্তন অবস্থান কিভাবে আইন বহাল রাখে তা এই আইনটি থেকে বুঝতে পারি। সন্তান মাতা ও পিতার। অতএব অভিভাবকত্ব হবে উভয়ের। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আইন দ্বারা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সময় এসেছে পরিবর্তনের। গত ২২ এপ্রিল নাবালক সন্তানের অভিভাবকত্ব নির্ধারণে নীতিমালা প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের  দ্বৈত হাইকোর্ট  বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ  দেন।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আগামী ৪ আগস্টের মধ্যে এই কমিটিকে নীতিমালা দাখিল করতে। আদালতের প্রতি সম্মান বজায় রেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব পালন করবেন, সেটাই প্রত্যাশিত। এই আইনের সুষ্ঠু পরিবর্তন হলে নারীর এতদিনের বঞ্চনার কিছুটা লাগব হতে পারে বলে আশা রাখতে পারি।

error: Content is protected !!